সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিল বিশ্ব ব্যাংক

সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিল বিশ্ব ব্যাংক

তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মনে করছে বিশ্ব ব্যাংক।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি হতাশার কথা জানিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক। এডিবি ও আইএমএফের চেয়েও কম জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর বিশ্ব ব্যাংকও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমাগত আর্থিক চ্যালেঞ্জের কারণে প্রবৃদ্ধির এই হাল হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

বুধবার প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট : ট্যাক্সিং টাইমস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে বড় তিন উন্নয়ন সংস্থাই বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে হতাশার কথা শোনাল।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের তৃতীয় দিনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ২১ এপ্রিল বৈঠকটি শুরু হয়েছে; শেষ হবে ২৬ এপ্রিল। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বৈঠকে অংশ নিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমাগত আর্থিক চ্যালেঞ্জের কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে উঠতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে গত জানুয়ারিতে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক।

নতুন পূর্বাভাসে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হতে পারে।

গত ৯ এপ্রিল প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) প্রতিবেদনে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এর আগে সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছিল, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে বলে প্রতিবেদনে বলেছে এডিবি।

বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার প্রকাশিত আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (এপ্রিল ২০২৫) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি।

এই তিন সংস্থার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক সবচেয়ে কম ৩ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিল। অতীতে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে আইএমএফ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ‘রক্ষণশীল’ পূর্বাভাস দিয়েছে। এডিবি একটু ‘উদার’ পূর্বাভাস দিয়েছে।

অর্থাৎ বরাবরই এই তিন সংস্থার মধ্যে আইএমএফের পূর্বাভাস সবচেয়ে কম থাকত। এডিবির বেশি থাকত। মাঝামাঝি থাকত বিশ্ব ব্যাংক।

এবার বিশ্ব ব্যাংক ‘রক্ষণশীল’ পূর্বাভাস দিল। অর্থাৎ চলতি অর্থ বছরে সবচেয়ে কম জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিল বিশ্ব ব্যাংক।

প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি কমার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “প্রাথমিকভাবে গত গ্রীষ্মে সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে উদ্ভূত ‘ব্যাঘাতগুলোর’ প্রভাব পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্ন হওয়ার ক্ষেত্রে এর যেমন প্রভাব দেখা গেছে তেমনি মূল্যস্ফীতির স্থায়িত্ব বাড়িয়েছে, ব্যাংক খাতের অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে, সরকারের পরিচালনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

“দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে সেটি নিয়েও সাধারণ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ সবকিছুর প্রতিফলন দেখা যেতে পারে বিনিয়োগ কমার ক্ষেত্রে।”

২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার।

তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের ৪ দশমিক ২২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অর্জনের খাত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বরাবরই দেখিয়ে আসছে।

বিবিএসের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে তা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ ওঠে। ওই প্রবৃদ্ধি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।

তার পরের বছর (২০১৯-২০ অর্থ বছর) কোভিড মহামারির ধাক্কায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল।

পরের বছর (২০২১-২২) ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে। তবে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আবার কমে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।

চলতি অর্থ বছরের তিন প্রান্তিক (নয় মাস, জুলাই-সেপ্টেম্বর, অক্টোবর-ডিসেম্বর ও জানুয়ারি-মার্চ) শেষ হয়েছে। গত ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে বলা হয়েছে, এই প্রান্তিকে দেশে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।

প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি অর্থনীতি মেরামতের কাজেও হাত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এখনও ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে কাঙ্খিত গতি আসেনি।

বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার ধাক্কা এশিয়ার প্রবৃদ্ধিতে

বিশ্ব ব্যাংকের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে, যা গত অক্টোবরে করা পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। তবে ২০২৬ সালে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে কিছুটা কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে।

আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকেও কম। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে এটি আরও কমে ২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।

ভুটানে কৃষি খাতে দুর্বলতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। তবে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে জলবিদ্যুৎ নির্মাণ খাতে গতি আসায় এটি ৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বিশ্ব ব্যাংক মনে করছে, মালদ্বীপে নতুন বিমানবন্দর টার্মিনাল উদ্বোধনের ফলে ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। তবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে দেশটির।

নেপালে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে এটি ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈদেশিক চাপ ও মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব কাটিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ৩ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

ঋণ পুনর্গঠনের অগ্রগতির কারণে ২০২৫ সালে শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। তবে ২০২৬ সালে এটি কিছুটা কমে ৩ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার বলেন, “এখনই সময় নির্দিষ্ট কিছু সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার; যাতে অর্থনীতির সহনশীলতা বাড়ে, প্রবৃদ্ধি জোরদার হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বাণিজ্য আরও উন্মুক্ত করতে হবে, কৃষি খাতে আধুনিকায়ন আনতে হবে এবং বেসরকারি খাতে গতি আনতে হবে।”

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশে নামবে : আইএমএফ পরবর্তী

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশে নামবে : আইএমএফ

কমেন্ট