বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামবে: গভর্নর
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োগ ও প্রভাব" শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন গভর্নর।
চলতি বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্র আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছেন, “জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামবে। আগস্টের মধ্যে তা ৭ শতাংশে নেমে আসবে। আর ২০২৫ সালের শেষে এটি ৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছি। মূল্যস্ফীতি ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে তখন সেটা মুদ্রার বিনিময় হারকে (এক্সচেঞ্জ রেট) সাপোর্ট দিতে পারবে।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োগ ও প্রভাব" শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন গভর্নর। দৈনিক বণিক বার্তা রাজধানীর একটি হোটেলে এই গোলটেবিলের আয়োজন করে।
দেশের অর্থনীতির স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫।
সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও এক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এক বছর ধরে (২০২৪ সালের মে থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত) গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি আছে। এই হার এখন ১০ দশমিক ২১।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর থেকেই চড়তে চড়তে আন্দোলনের মাস গত বছরের জুলাইয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে আসে। চার মাস পর এই সূচক সিঙ্গেল ডিজিটে নামে।
মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকলে বিনিময় হার স্ট্যাবল (স্থিতিশীল) রাখা কঠিন মন্তব্য করে গোলটেবিল বৈঠকে গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, “ইনফ্লেশনকে ৩-৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। ভারত ও আমেরিকাতে এটা ২-৩ শতাংশ। আমাদেরও সে জায়গায় আসতে হবে। আমার ইনফ্লেশন রেট আগামী দুই বছর যদি সাড়ে ৯ শতাংশ হয়, তাহলে আমি কীভাবে বিনিময় হারকে ধরে রাখব।
“আমি যদি সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঠিক না করতে পারি, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক ভারসাম্য ঠিক না করতে পারি, তাহলে তো এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক রাখতে পারব না। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে।”
তিনি বলেন, "আমাকে অনেকেই বলছে ব্যাংকগুলোতে ইন্সপেকশন পাঠাতে, বাট আমি রাজি হইনি। যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার মার্কেট ইন্টারভেনশন ফান্ড গঠন করা হয়েছে, এটা ব্যবহার করতে হবে না বলে আমি মনে করি। এটাকে আমি রাখব—বাট ব্যবহার করতেই হবে, এমন নয়।
“ঢাল-তলোয়ার হাতে থাকলেই কি মানুষ মারতে হবে!”
আমদানি সংকোচন করা হয়নি জানিয়ে গভর্নর বলেন, "আগে আমরা যে পরিমাণ কমোডিটি (পণ্য) আমদানি করতাম, এখনও সে পরিমাণই করছি। পার্থক্য হলো-বিশ্ববাজারে দাম কমেছে, যেটা আমাদের হেল্প করছে। আমি আমদানিতে বিধিনিষেধ দেওয়ার পক্ষপাতী নই। ট্যাক্স দিয়ে কেউ যদি লাক্সারি (বিলাস) পণ্য ব্যবহার করতে চায়, আমার সমস্যা নেই।"
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোকে বলব, ফরোয়ার্ড মার্কেটকে ডেভেলপ করার চেষ্টা করেন। ব্যবসায়ীদের বলব, আপনারা এক্সচেঞ্জ রিস্ক নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্যালকুলেশন করবেন। ডেফার্ড পেমেন্টে রিস্ক মনে করলে স্পটে পেমেন্ট করে দিন।"
বাংলাদেশিদের শত শত বিলিয়ন ডলার বাইরে আছে উল্লেখ করে আহসান মনসুর বলেন, "আমরা নিজেরাই নিজেদের গরিব করে রাখি। এটা তারা বাইরে রাখে, সম্পদের সিকিউরিটির (নিরাপত্তার) জন্য। আমরা যদি এই সিকিউরিটি মেন্টেইন করতে না পারি, তাহলে ক্যাপিটাল ফ্লাইট থামানো যাবে না।"
"দুই-আড়াই লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে চলে গেলো। এটার একটা প্রভাব তো দেশে থাকবেই। এই কারণে অনেক রেট অফার করার পরও—ডিপোজিট গ্রোথ হচ্ছে না। কারণ, টাকাটা তো দেশে নাই। আমাদের এক্ষেত্রে ফরেক্স রিজার্ভ বিল্ড আপ করার মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে।"
গভর্নর বলেন, "আমি আবারও বলতে চাই, এক্সচেঞ্জ রেট বাংলাদেশেই নির্ধারণ হবে, দুবাই বা অন্য দেশে নয়। কোনো এগ্রিগেটর ৫ কার্যদিবসের বেশি ডলার ধরে রাখতে পারবে না।"
দাম বাড়ার আশায় ডলার ধরে রাখবেন না
প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশে গভর্নর আহসান মনসুর বলেন, দাম বাড়ার আশায় ডলার ধরে রাখবেন না। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও ডলারের দর স্থিতিশীল থাকবে।
তিনি বলেন, “অনেক দিন ধরেই আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছিল আমাদের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য। কিন্তু কখন এটা করব? এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছিল। অনেকেই বলেছেন আইএমএফের শর্তগুলো আমরা পরিপালন করতে পারব না। আগের সরকার একটাও পূরণ করতে পারেনি এটা সত্য, কিন্তু আমরা সব কটি পূরণ করেছি।”
"আমি সব রেমিটার্সদের বলবো, আপনারা স্পেকুলেশন করবেন না—ডলারের রেট হুট করে অনেক বেশি বেড়ে যাবে না। পরিবারের কাছে আপনারা চাইলে টাকা পাঠাতে পারেন। এগুলো পরে পাঠালে খুব বেশি লাভ হবে না।"
"আমি ব্যাংকগুলোকে বলবো, আপনারা স্কুলে যান। আপনি যদি সেখান থেকে একজন গ্রাহক তৈরি করতে পারেন, তাহলে সে হয়তো সারাজীবনের জন্য আপনার গ্রাহকে পরিণত হবে, যদি সার্ভিসটা ঠিক রাখা যায়। তারাই সামনে রেমিটার হয়ে আপনার ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাবে।"
বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, জিপিএইচ ইস্পাত ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব, প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর উজমা চৌধুরী, মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের রিজিওনাল অপারেশন ম্যানেজার শিহাবুল হাসান প্রমুখ।
কমেন্ট